একটি হৃদয় নিংড়ানো প্রেমের গল্প
আচ্ছা তামান্না!তোমার কি মনে আছে সেই দিনটার কথা?যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো?
প্রায় দুবছর পর আমি শহর থেকে গ্রামে এসেছিলাম।আমার পরনে ছিলো পাজামা আর ফতুয়া।তখনকার সময়ের জন্য এটা বেশ আধুনিক পোশাক।তুমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলে।তোমার পরনে ছিলো স্কুলড্রেস।বান্ ধবীদের সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলে তুমি।হঠাৎ তোমার স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়।তুমি বুঝতে পারছিলে না স্যান্ডেলজোড়া কি ফেলে চলে যাবে নাকি হাতে করে নিয়ে যাবে।আমি ঠিক তখন তোমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম।ব্যপা রটা বুঝতে পেরে আমি হাতে ঈশারায় তোমাকে বললাম স্যান্ডেলটা আমার কাছে দিতে।তুমি না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে।তখন আমি নিজেই তোমার কাছ থেকে স্যান্ডেলটা নিয়ে ব্যাগ থেকে আমার সিগারেট খাওয়ার ম্যাচ আর এক টুকরো তার বের করে তোমার স্যান্ডেলটা ঠিক করে দিয়েছিলাম।তুমি একটা মূহুর্তের জন্য আমার দিকে তাকালেনা।উল্টো মুখে হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে রাখলে।তোমার বান্ধবীরা ফিসফিস করে হাসতে লাগলো।আমি চোখের কোণা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম তারা চোখ টিপে টিপে হাসছে আর একজন আরেকজনের গাঁয়ে চিমটি কাটছে।যার অর্থ ছিলো ছেলেটা কি ওকে দেখে প্রেমে পড়ে গেলো নাকি?
স্যান্ডেল ঠিক হওয়ার পর তুমি আমাকে কিছুই বললেনা।ধন্যবাদ বা সৌজন্যমূলক কোন কথাও বললেনা।গ্রামে মনে হয় তখনো এসবের চল শুরু হয়নি।দ্রুত হাঁটতে শুরু করলে তুমি।তখন তোমার চুলের বাঁধন খুলে যায় আর তোমার হাঁটু অব্দি লম্বা চুলগুলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।তুমি সামান্য দূরে গিয়ে একটু ফিরে তাকিয়েছিলে আমার দিকে।কেন জানিনা জীবনে প্রথমবারের মত মনে হচ্ছিলো প্রেমে পড়েছি আমি।
আমার সমস্ত দুনিয়া উলটপালট হয়ে গিয়েছিলো সেদিন।কোনোকিছুত েই মন বসাতে পারছিলাম না।পরেরদিন খুব ভোরে উঠে তুমি যেই রাস্তা দিয়ে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরেছিলে সেখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম।আম ার মনেই ছিলোনা স্কুল এতো সকালে শুরু হয়না।তুমি এলে প্রায় নয়টার দিকে।দূর থেকে তোমাকে দেখেই আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গিয়েছিলো।একবার মনে হলো চলে যাই।কিসব ছেলেমানুষী কাজ করছি আমি।কিন্তু অদৃশ্য একটা আকর্ষণ আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখলো সেখানে।তুমি কিছুটা দূর থেকেই লক্ষ করলে আমাকে।আমাকে দেখে তুমিও অনেকটা জরোসরো হয়ে গিয়েছিলে।তখন তোমার হাঁটার গতি একবার বাড়ে আরেকবার কমে।তোমার বান্ধবীরা ঠিকি বুঝেছিলো আমি তোমার জন্যই এখানে দাঁড়িয়ে আছি।ওরা তোমাকে হেঁয়ালীর ছলে গুঁতা দিচ্ছিল।তুমি যে মাটির দিকে তাকিয়ে চলে গেলে একটাবারও মুখ তুলে তাকালে না।
সেদিন ছুটির সময়েও দাঁড়িয়েছিলাম আমি।তোমার বান্ধবীরা তখন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো আমি তোমার জন্যই দাঁড়িয়েছি।তখন তারা অনেকটা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়েই তোমাকে বলছিলো,"দেখ দেখ!ছেলেটা তোকে দেখার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে।" তুমি তখন চাপাচাপি করে তোমার বান্ধবীদের থামতে বলছিলে।আমি ঠিকি খেয়াল করেছিলাম তোমার ঠোঁটের কোণায় তখন একটা হাসি ছিলো।
স্কুলেরই বাচ্চা একটা ছেলের কাছ থেকে তোমার ব্যপারে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তুমি আমাদের গ্রামের না।তুমি পাশের গ্রামের রহমত আলী নামক একজন ইমাম সাহেবের মেয়ে।তোমার নাম তামান্না।ক্লাস টেনে পড়ো।
পরেরদিন ছিলো শুক্রবার।আমি অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিয়ে গ্রামে এসেছিলাম।সেদিন বিকালে শহরে ফিরে পরেরদিন অফিস ধরার কথা।আমি ফিরবোনা ঠিক করলাম।অফিসে চিঠি পাঠালাম আমি অসুস্থ বলে।ফিরতে আরো দুদিন দেরী হবে।
শুক্রবার বলে সেদিন স্কুল বন্ধ ছিলো।সব জেনেও আমি সেই রাস্তাটায় বেলা বারোটা পর্যন্ত না খেয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।মন ে ক্ষীণ আশা ছিলো হয়তো কোনো কারণবশত তুমি আসতে পারো।কিন্তু তুমি আসোনি।
বিকালে ঠিক করলাম তোমাদের গ্রামে যাবো।তোমাকে এক নজর না দেখে শান্তি হচ্ছিলোনা আমার।
তোমাদের গ্রামের নাম সাধুপী।গ্রামের রাস্তাঘাট তো চিনিনা।তোমাদের বাসা কোনদিকে তাও জানিনা।তারউপর কেউ যদি জানতে চায় কেন এসেছি-কী জবাব দেবো তখন?এই ভয়টাও ছিলো মনে।কিন্তু ভাগ্য ভালো কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলোনা।একিসাথে ভাগ্যটা খারাপও ছিলো।সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করেও তোমাকে পেলাম না।ফিরে এসেছিলাম বাড়িতে।
এর পরের দুইদিন এভাবেই সকাল বিকাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখে দেখে শহরে ফিরে এলাম।ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আবার অফিস নিয়ে।
কিন্তু কোনো কাজেই মন বসাতে পারছিলাম না।সারাক্ষণ তোমার কথা মনে হচ্ছিলো,তোমার লাল হয়ে যাওয়া চেহারার মাঝে ফুটে উঠা হাসিটার কথা মনে হচ্ছিলো।বারবার মনে হচ্ছিলো তোমাকে আমার দরকার।খুব দরকার।
একমাস পর আবার ছুটি নিয়ে গ্রামে এসেছিলাম।আমার মনে আছে সিএনজিওয়ালাকে বলেছিলাম ভাই খুব তারাতারি যান।যেন আস্তে গেলেই তোমাকে হারিয়ে ফেলবো এরকম একটা অবস্থা।তোমাকে দেখার জন্য তর সইছিলো না আমার।
সকালবেলা সেই রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে আছি।তুমি ঠিক নয়টার দিকেই আসলে।আমাকে দেখতেই তোমার বান্ধবীরা কেমন যেন একটা চাপা শোরগোল শুরু করলো।দেখলাম তুমি তাদের থামিয়ে কিছু একটা বলার পর ওরা হাসাহাসি করতে করতে তোমাকে ফেলে চলে গেলো।তারপর শুধু তুমি আর আমি,পুরো রাস্তায় আর কেউ নেই।আমার পাশটায় এসে তুমি খু্ব ধীরে ধীরে হাঁটছিলে মাথা নিচু করে।স্পষ্ট ইঙ্গিত-তুমি চাইছো আমি তোমার সাথে কথা বলি।তুমি আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলে,আর আমি অপ্রস্তুতভাবে ভাবছিলাম কী করবো।শেষমেশ ডাক দিয়েই ফেললাম,"এই শোনো।"তুমি যেন আমার ডাক শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলে এমনভাবে ফিরে তাকালে।সাথেসাথে আমার বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেলো।তুমি দুতিন পা পিছনে এসে নিচের দিকে তাকিয়েই বললে,"কিছু বলবেন?" তোমার কথা শুনে আমার বুকের ধুকপুকানী আরো বেড়ে গেলো।আমার মুখ দিয়ে কোনোই কথা বেরুচ্ছিল না।তখন তুমিই আবার বললে,"আপনি এতোদিন কোথায় ছিলেন?" তোমার গলায় চাপা অভিমান ছিলো আমি বুঝেছিলাম।আমার মনে হচ্ছিলো তুমি আসলে বলতে চাইছিলে-"আপনি এতদিন এই রাস্তাটায় দাঁড়ান নি কেন?আমি আপনাকে মিস করেছি।"আমি বললাম,"আমার তো কাজ আছে,অফিস আছে।তাই চলে গিয়েছিলাম।"
-কিন্তু আপনি যখন আগেরবার এসেছিলেন তখন আমাদের গ্রামে গিয়েছিলেন কেন?!
-সেকি!তুমি আমাকে দেখেছিলে?
-হ্যাঁ দেখেছিলাম।মনে হলো আপনি কাউকে খুঁজছেন!
-না মানে,আমি তোমাকেই...!কথা বলতে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলাম আমি।অথচ এই আমিই শহুরে মেয়েদের সাথে কত সাবলীলভাবে কথা বলি।আমার অবস্থা দেখে তুমি হেসে ফেললে।তোমার হাসিতে আমার হার্টবিট থেমে যাওয়ার যোগাড়।এতো সুন্দর করে কেউ হাসতে পারে?পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য যেন লুকিয়ে ছিলো তোমার হাসিতে।আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিলাম অনেকক্ষণ।হাসি থামিয়ে তুমি জানতে চাইলে আর কদিন থাকবো আমি।জবাবে যখন বললাম আজ বিকালেই চলে যাবো তখন হঠাৎ করেই তোমার মুখটা করুণ হয়ে গিয়েছিলো।তুমি হাসিমুখটা ধরে রাখার চেষ্টা করেও পারছিলে না।অনেকটা সময় এভাবে বাকহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি কিছু না ভেবেই তোমাকে বলে বসলাম,"আজকের দিনটা কি তুমি আমার সাথে থাকবে?"আমার কথায় তুমি চমকে উঠে জানতে চাইলে,"এটা কিভাবে সম্ভব?" আমি বলেছিলাম,"আজ তো বৃহস্পতিবার,তোম ার হাফ ক্লাস।তুমি যদি আজ স্কুল ফাঁকি দাও তাহলে আমরা কোথাও গিয়ে বসতে পারি।"তুমি সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আমার কথাগুলা বুঝার চেষ্টা করলে।মেয়েরা চোখের দিকে তাকিয়েই নাকি অনেক কিছু বুঝতে পারে।তুমিও হয়তো বুঝেছিলে আমার কোনো কূমতলব নেই।তখন তুমি নিজে নিজেই বিরবির করে বলছিলে কেউ যদি দেখে তাহলে খুব খারাপ হবে।শেষে আরেকটু ভেবেচিন্তে বললে,"ঠিক আছে চলুন।"
-কিন্তু আপনি যখন আগেরবার এসেছিলেন তখন আমাদের গ্রামে গিয়েছিলেন কেন?!
-সেকি!তুমি আমাকে দেখেছিলে?
-হ্যাঁ দেখেছিলাম।মনে হলো আপনি কাউকে খুঁজছেন!
-না মানে,আমি তোমাকেই...!কথা বলতে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলাম আমি।অথচ এই আমিই শহুরে মেয়েদের সাথে কত সাবলীলভাবে কথা বলি।আমার অবস্থা দেখে তুমি হেসে ফেললে।তোমার হাসিতে আমার হার্টবিট থেমে যাওয়ার যোগাড়।এতো সুন্দর করে কেউ হাসতে পারে?পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য যেন লুকিয়ে ছিলো তোমার হাসিতে।আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিলাম অনেকক্ষণ।হাসি থামিয়ে তুমি জানতে চাইলে আর কদিন থাকবো আমি।জবাবে যখন বললাম আজ বিকালেই চলে যাবো তখন হঠাৎ করেই তোমার মুখটা করুণ হয়ে গিয়েছিলো।তুমি হাসিমুখটা ধরে রাখার চেষ্টা করেও পারছিলে না।অনেকটা সময় এভাবে বাকহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি কিছু না ভেবেই তোমাকে বলে বসলাম,"আজকের দিনটা কি তুমি আমার সাথে থাকবে?"আমার কথায় তুমি চমকে উঠে জানতে চাইলে,"এটা কিভাবে সম্ভব?" আমি বলেছিলাম,"আজ তো বৃহস্পতিবার,তোম
মনে আছে তোমার সেদিনটার কথা?আমার কথায় তুমি স্কুল ফাঁকি দিয়েছিলে।আমাকে নিয়ে গিয়েছিলে বিশাল একটা মাঠে।মাঠের ঠিক মাঝখানটায় বেশ বড়সর একটা কদমগাছ চারদিকে ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে।আমরা সেই গাছটার গুড়িতে বসেছিলাম।আমরা দুজনেই লজ্জা পাচ্ছিলাম বেশি,কথা বলছিলাম কম।কথা বলার মাঝখানে একটা বিদঘুটে গরু আমাদের দিকে তেড়ে এসেছিলো।তখন তো আমার কলিজায় কোনো পানি নেই।আমার অজান্তেই তোমার বাম হাতটা ধরে ফেলেছিলাম।তুমি চমকে উঠেছিলে বটে,কিন্তু হাতটা ছাড়ানোর কোনো চেষ্টা করলেনা।গরুটা কাছে আসতেই তুমি কী সুন্দর করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে আর সাথেসাথে গরুটা শান্ত হয়ে গেলো।আমি তবুও ভয় পাচ্ছিলাম।তুমি আমাকে অভয় দিলে আর কিছু করবেনা ওটা।
সেদিনের প্রতিটা কথা আমার কানে এখনো বাজে তামান্না।আমি চোখবন্ধ করলেই দেখি ওই মাঠটায় তুমি আর আমি হাত ধরাধরি করে বসে আছি।তুমি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছো,আমি চুপ করে শুনছি।চোখ খুলতেই সবকিছু কেমন যেন ধূসর হয়ে যায়।
সেদিনের পর সবকিছু কেমন যেন দ্রুত একটার পর একটা ঘটে যায়।আমি আম্মা আব্বার কাছে তোমার কথা বলি,ওরা তোমাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে।ওরা তোমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়।তোমার বাবা বললেন তোমার মেট্টিক পরীক্ষা কদিন পরেই।তাই বিয়ের তারিখটা যেন তোমার পরীক্ষার পর ফেলা হয়।আমার বাবা মা মেনে নেন।
তারপর কোনো এক জানুয়ারী মাসের পাঁচ তারিখ বিয়ে হয় আমাদের।সবকিছু এত সহজে হয়ে গেল মনে হচ্ছিলো যেন স্বপ্নে ঘটছে সব।
আমার স্পষ্ট মনে আছে,তুমি বিয়ের পর প্রথম প্রথম শহুরে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারতেনা।আমাকে ছাড়া কখনোই বাইরে যেতেনা,আর গেলেও ইয়া বড় ঢাউস একটা বোরখা পরে যেতে।
তোমার কি মনে আছে তামান্না!তুমি প্রায়ই মাঝরাতে আমাকে ডেকে তুলে ছাদে নিয়ে গিয়ে তারা গুণতে।আমি মুখে প্রথমে বিরক্তি প্রকাশ করতাম,কিন্তু আসলে আমার খুব ভালো লাগতো।কতরাত যে আমরা এভাবে না ঘুমিয়ে তারা গুণে কাটিয়েছি তার কোনো হিসেব নেই।খুব সাবধানে দরজা খুলে ছাদে যেতাম আমরা,যেন মা বাবা কেউ দেখতে না পায়।একদিন তো আমার পাঁজি ভাইটা দেখে ফেললো।তার সে কী হাসি।
আমরা মাঝেমাঝেই ভোর সকালে খালিপায়ে হাঁটতে যেতাম।একদিন আমি দূর্বাঘাস দিয়ে একটা আংটি বানিয়ে তোমাকে পরিয়ে দিয়েছিলাম।তুমি লজ্জায় মুখ তুলে তাকাওনি আমার দিকে।
তুমি কখনো মুখে বলোনি আমাকে ভালোবাসো।কিন্তু প্রতিটা শবে বরাতের রাতে তুমি আমার জন্য প্রার্থনা করতে আল্লাহর কাছে।একটা সময় আমাদের বাসায় ইঁদুরের উৎপাত দেখা দেয়।শেষে সহ্য করতে না পেরে তোমাকে শুনিয়ে বললাম,"নাহ আর পারা যাচ্ছেনা।কাল ইঁদুর মারার ওষুধ নিয়ে আসবো।" তুমি বললে ওষুধ আনার দরকার নাই।বরং আমি যেন এমন কোনো ফাঁদের ব্যাবস্থা করি যেখানে ইঁদুর ধরা পরবে,এবং ধরা পরলে পরেরদিন জীবিত অবস্থায় ইদুরকে দূরে ফেলে আসতে।তোমার কথায় আমি অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম-ওষুধ দিয়ে ইঁদুর মারলে সমস্যা কী?তুমি ভীতকন্ঠে উত্তর দিয়েছিলে-যদি তুমি ওষুধ দিয়ে ইঁদুরগুলা মেরে ফেলো তখন সেই ইঁদুরের বাচ্চা অথবা মা বাবা যদি তোমাকে বদদোয়া দেয়,তাতে তোমার ক্ষতি হতে পারে।
তোমার কথাটা শুনে এক মূহুর্তের জন্য নিস্তব্দ হয়ে গিয়েছিলাম আমি।বিশ্বাস করো এতোটা ভালোবাসা বহন করার ক্ষমতা আমার ছিলোনা।
তোমার কখনো মন খারাপ হলে সোজাসোজি আমাকে এসে বলতে,"আমার মন খারাপ।আমার মন ভালো করে দাও এক্ষুনি।" অনেকটা মামাবাড়ির আবদারের মত।আমি যদি বলতাম ব্যস্ত আছি,তখন তুমি আমার নাকে মুখে কিল শুরু করতে।বিশ্বাস করো,শুধুমাত্র তোমার কিলগুলা খাওয়ার জন্যই আমি ব্যস্ত আছি কথাটা বলতাম।
আমার মারাত্বক রকমের কাতুকুতু ছিলো।সেই সুযোগটা ভালোভাবেই নিতে তুমি।উল্টাপাল্ট া কিছু করলেই কাতুকুতু দিতে আর আমার সমস্ত শক্তি দিয়েও ছুটতে পারতাম না।
তোমার মনে আছে তামান্না!একদিন আমি বলেছিলাম আজ শরীরটা ব্যথা করছে।তুমি সেদিন আমার পিঠে মালিশ করে দিয়েছিলে।এরপর থেকে এটা কেমন যেন অভ্যাস হয়ে গেলো আমার।ব্যথা না থাকলেও এমনি এমনিই বলতাম ব্যথা করছে।একদিন তুমি মালিশ করতে করতেই হাসতে হাসতে বললে-আমি জানি তোমার শরীরে কোনো ব্যথা নেই।তাও তুমি শুধু মালিশ করানোর জন্য আমাকে বলো তোমার শরীর ব্যথা করছে।তাই না সুমু?ধরা পরে বোকার মত হাসছিলাম আমি।তখন তুমি ধমক দিয়ে বললে চুপ করে শুয়ে থাকো।নইলে মালিশ করতে পারবোনা।
তুমি কোনোদিন আমাদের রুমে দুইটা বালিশ রাখতে দাওনি।তুমি বলতে তুমি আর আমি মিলে তো একজনই,তো বালিশ কেন দুইটা লাগবে?
ফুচকা তোমার খুবই প্রিয় ছিলো।কেন জানিনা আমার অফিসে যেদিন ইম্পর্টেন্ট মিটিং থাকতো সেদিনই তোমার ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছা হতো।তুমি টাই'টা বেঁধে দিতে দিতে গাল ফুলিয়ে বলতে,"যত ইম্পর্টেন্ট মিটিংই হোক,সন্ধ্যাবেলা আমাকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যেতেই হবে কিন্তু।নইলে আজকে রাতে কিছুই পাবে না বলে দিলাম।"
প্রায় প্রতি বর্ষাতেই গ্রামে যেতাম আমরা।ছোট একটা নৌকায় করে বিলে ঘুরতাম।আমার নৌকায় উঠতে একিসাথে ভালো লাগতো,আবার ভয়ও করতো।তুমি বেশ ভালো নৌকা চালাতে পারতে।আমি পারতাম না।প্রথম যেদিন বৈঠা নিয়ে বাইতে শুরু করলাম তখন অবাক হয়ে দেখলাম নৌকা শুধু একি জায়গায় ঘুরে।অথচ তুমি নৌকা বাইলে যেদিকে নিতে চাও সেদিকেই যায়।তুমি তো হাসতে হাসতে শেষ আমার নৌকা বাওয়া দেখে।তারপর শিখিয়ে দিলে কিভাবে ইচ্ছামত নৌকা বাইতে হয়।জানো!আমি আজও খুব ভালো নৌকা বাইতে জানি।
ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার সময়গুলো মনে পড়ে তোমার?আমি ভিজতে চাইতাম না,কিন্তু তুমি জোর করে নিয়ে যেতে।ভিজতে আর তোমার গ্রামের গল্প শোনাতে।বলতে ছাদে ভেজার চেয়ে গ্রামের রাস্তায় ভিজার মজা বেশি।আমি বুঝতাম না এক জায়গায় মজা বেশি আরেক জায়গায় কম কেন হবে?সব জায়গার বৃষ্টিইতো এক।
শাড়ী নিয়ে তোমার করা কান্ডগুলার কথা আমার সব স্পষ্ট মনে আছে।শাড়ী ছিলো তোমার মারাত্বক প্রিয় একটা জিনিস।তোমার শপিং মানেই ছিলো শুধু শাড়ী।তোমার মত এতো সুন্দর করে শাড়ী পরতে আর কাউকে দেখিনি আমি।আর শাড়ী পরাটা খুব উপভোগ করতে তুমি।যখন কেউ হঠাৎ খুব সুন্দর জায়গায় যায়,তখন সে যেমন জায়গাটা অবাক হয়ে উপভোগ করে,ঠিক সেরকমই ছিলো শাড়ী পরার সময় তোমার অবস্থা।আর আমাকে ফ্লোরে বসিয়ে রাখতে শাড়ীর কুচি ঠিক করার জন্য।
তারপর?
তারপর সময় কত দ্রুত চলে গেলো।যেন একেকটা সেকেন্ডে একদিন পার হলো।বিয়ের চার বছরের মাথায় ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো আমাদের।সাত বছরের মাথায় হলো একটা ছেলে।দশ বছরের মাথায় অনেকটাই মুটিয়ে গেলে তুমি।তোমার মনে আছে,আমি যে তোমাকে বাচ্চা হাতী বলে ক্ষেপাতাম?তোমার আমার বয়সের ব্যাবধান ছিলো অনেক।প্রায় দশ বছরের ছোট ছিলে তুমি আমার।তোমার বাচ্চামীগুলা শেষদিন পর্যন্ত যায়নি।আমি তোমাকে মুটি বললেই উরুধ ধুরুম কিলাতে শুরু করতে।গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে।তখন আমি তোমার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলতাম,"আমার বউটা মুটি হোক বা চিকন হোক,বউটা তো আমারি?সে সবসময়ই আমার কাছে প্রকৃত সৌন্দর্যের উদাহরণ।" আমার এসব কথায় ভীষণ লজ্জা পেতে তুমি।বয়স বাড়লো,তোমার লজ্জা কমলোনা।
তারপর সময় কত দ্রুত চলে গেলো।যেন একেকটা সেকেন্ডে একদিন পার হলো।বিয়ের চার বছরের মাথায় ফুটফুটে একটা মেয়ে হলো আমাদের।সাত বছরের মাথায় হলো একটা ছেলে।দশ বছরের মাথায় অনেকটাই মুটিয়ে গেলে তুমি।তোমার মনে আছে,আমি যে তোমাকে বাচ্চা হাতী বলে ক্ষেপাতাম?তোমার
তারপর যেন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম আমরা বুড়ো হয়ে গেছি।আমাদের বাচ্চাকাচ্চাগুল া বড় হয়ে গেছে,আমাদের চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে,আমাদের মেয়েটার একটা ছেলে হয়েছে,যে আমাদের নানা নানু ডাকতে পারেনা,নান্ নান্ বলে ডাকে অস্পষ্টভাবে।
কিন্তু আমাদের শারীরিক কিছু পরিবর্তন ছাড়া আর তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।তুমি সেই আগের মতই আমার মিথ্যে ব্যথায় মালিশ করে দাও,মুটি বললে ক্ষেপে গিয়ে কিলাতে শুরু করো,ফুচকা খাওয়ার বায়না ধরো।আমাদের বয়সী দুইজন বুড়োবুড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে,কি অদ্ভূত না দৃশ্যটা?
সারাটাজীবনে আমাদের কখনো ছন্দপতন হয়নি।
সেদিনের কথা!তোমার সামান্য জ্বর হলো।খুবই সামান্য জ্বর।তোমাকে ওষুধ খাইয়ে কোথায় যেন গিয়েছিলাম।হঠাৎ ছেলের ফোন।ফোন ধরতেই ছেলে চীৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করলো।"বাবা তারাতারি বাসায় আসো বাবা,মা যেন কেমন করছে।"
যন্ত্রের মত বাড়ি ফিরেছিলাম।তোমার তখন শেষ সময়।তোমার হাতটা ধরতেই তোমার ঠোটের কোণে অস্ফুট হাসি ফুটলো।ঠিক সেরকম দৃশ্য,যখন আমি গরুর গুঁতো খাওয়ার ভয়ে প্রথমবার তোমার হাত ধরেছিলাম।তুমি কাঁপা কাঁপা হাতে কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করলে।তোমার হাতের ঈশারা অনুসরণ করে দেখলাম তুমি আমাদের রুমের কোণায় রাখা ছোট ট্রাঙ্কটা দেখাচ্ছ।যে ট্রাঙ্কটায় তুমি আমাকে কখনো ধরতে দাওনি।সেটা খুলে দেখলাম ওখানে বহু পুরনো জীর্ণশীর্ণ একজোড়া স্যান্ডেল রাখা।মূহুর্তেই মনে পড়ে গেলো,তোমার এই স্যান্ডেলটাই প্রথম দেখার দিন আমি ঠিক করে দিয়েছিলাম।তুমি কিছু বলতে চাইলে তখন।তোমার মুখের কাছে কান নিতেই তুমি শান্ত শীতল কন্ঠে বললে,"আমাকে দেয়া তোমার প্রথম উপহার।এটা আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম।তুমি খুব ভালোমানুষ সুমু।আল্লাহ যেন আবার আমাদের দেখা করায়।"
পরমূহুর্তেই তোমার নিঃশব্দ গোঙানী,তারপর সব শেষ।উপস্থিত সবাই কান্নায় ভেঙে পড়লো,কিন্তু আমি যেই পাথরের মত তোমার হাত ধরে বসে ছিলাম সেভাবেই বসে রইলাম।সবাই আমার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলো।সবাই আমাকে কান্না করানোর চেষ্টা করলো,তবুও আমি কাঁদলাম না।ছেলেমেয়ে দুইটা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছিলো,তবুও আমি কাঁদলাম না।কিন্তু ইমাম যখন তোমার লাশটা খাটিয়ায় রেখে জানাযার নামাজের উদ্যেশ্যে 'আল্লাহু আকবার' বলে তাক্ববীর ধ্বনি দিলেন,ঠিক সেই মূহুর্তে আমার মোহ ভাঙল।ইমামের তাক্ববীর ধ্বনিটাকে আমার মনে হচ্ছিল ফেরেশতা ইসরাফীলের শিঙ্গার ফুৎকার,যে ফুৎকারে আমার পুরো পৃথিবীতে কেয়ামত ঘটে যাচ্ছিলো।আমি আর সামলাতে পারিনি নিজেকে।জানাযার নামাজে দাঁড়ানো হাজারো মানুষের সামনেই জ্ঞ্যান হারিয়েছিলাম।
প্রিয় তামান্না!তুমি নেই আজ প্রায় দেড় বছর হতে চললো।আজকাল কেন জানি খুব বেশিই তোমার শূণ্যতাটা অনুভব করি।খুব করে তোমাকে ছুঁতে ইচ্ছা হয়,তোমার গাঁয়ের গন্ধটা শুকতে ইচ্ছা হয়।অথচ দেখো!এই মূহুর্তে আমার থেকে মাত্র সাড়ে তিনহাত দূরে তুমি।তবুও কেন আমার ইচ্ছাগুলা পূরণ হচ্ছেনা?
সবকিছুতে তো আমিই প্রথম ছিলাম।তোমাকে দেখলাম আমি আগে,তোমাকে ভালোবাসলাম আমি আগে,তোমার হাত ধরলাম আমি আগে।কিন্তু বিদায়টা কেন তোমাকে আগে নিতে হলো?তুমি তো বয়সে আমার কত ছোট।নিয়ম অনুযায়ী আমার আগে বিদায় নেয়ার কথা।শুধু আমাদের বেলাতেই কেন নিয়ম উলটপালট হয়ে গেলো?এই বুড়ো মানুষটাকে জাগিয়ে রেখে তুমি চিরতরে ঘুমিয়ে গেলে।তোমার একটুও খারাপ লাগলোনা?
তুমি কিন্তু একটা মূহুর্তের জন্য আমার মন থেকে সরোনি।প্রতিটা মিলিসেকেন্ড আমি তোমাকে মনে রেখেছি।তুমি আমার প্রেমিকা কিংবা বউ হলে হয়তো কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমার চিন্তার বাইরে যেতে।কিন্তু তুমিইতো বলেছিলে তুমি আমার অর্ধাঙ্গীনী।নিজ ের অর্ধেক অংশকে কি কখনো ভূলতে পারা যায়?আর জানো,সেই কদমগাছটার একটা নাম দিয়েছি আমি।যে গাছটায় প্রথমবার বসে কথা বলেছিলাম আমরা। ' সুমন্তামান্না গাছ। '
আমাদের আবার কবে দেখা হবে তামান্না?খুব দ্রুতই হবে তাইনা?আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি,ওনি যেন অতি স্বত্বর তোমার সাথে আমার দেখা করান।শুনেছি মৃত্যুর পরের জীবনটা নাকি অসীম।তখনতো আর তোমাকে হারানোর ভয় থাকবেনা।
সেদিন আমি তোমাকে আবারও বলবো,"তোমাকে ঠিক ততটাই ভালোবাসি,একজন ক্লান্ত অভুক্ত কৃষক যতটা ভালোবাসে একপ্লেট গরম ভাত এবং একবাটি পুটিমাছের ঝোল।
No comments