পতন-উত্থান (সাজ্জাদ সিয়াম )
পতন-উত্থান
সাজ্জাদ সিয়াম
সাজ্জাদ সিয়াম
রাত ন'টা। বাহিরে নূপুরধ্বনির মতো সুরেলা ঢেউ তুলে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। কিছুক্ষণ আগেও ল্যাম্পপোস্টে আলো দপদপ করে জ্বলছিল। এখন অবশ্য বিজলি চমকানো ব্যতীত ঘোর অন্ধকার ভেদ করে আবছায়া কিছুও দেখা যাচ্ছে না। আমি একটা বন্ধ দোকানের বারান্দায় আটকে গেছি। অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে আছি। ব্যাগ থেকে খাতা বের করে দুচার লাইন কবিতা আওড়াচ্ছি।
"যেখানে হাওয়ার মিছিলে দোদুল্যমান গাছের ছায়ারা গোল্লাছুট খেলে
সেখানেও আমাকে পাবে নীল রোদ্দুরের খামে
যেখানে অভিশপ্ত ও অবহেলিত ভালোবাসারা ধূসর রঙে ঘর বাঁধে
সে ঘরেও আমাকে পাবে পূর্ণিমার চাঁদ হিসেবে
যেখানে..."
সেখানেও আমাকে পাবে নীল রোদ্দুরের খামে
যেখানে অভিশপ্ত ও অবহেলিত ভালোবাসারা ধূসর রঙে ঘর বাঁধে
সে ঘরেও আমাকে পাবে পূর্ণিমার চাঁদ হিসেবে
যেখানে..."
এভাবে যখন কবিতার ঘোরে নিজেকে একটু আত্মমগ্ন করতে যাবো ঠিক তখনি আচমকা টের পেলাম বৃষ্টি থেমে গেছে। তাই অসমাপ্ত কবিতার খাতাটাকে ব্যাগে ভরে মোবাইলের টিপটাপ আলোতে বাড়ির দিকে রওনা দেই। কিছু স্মৃতি থাকে ভুলবার নয়, বহনযোগ্যও নয়। কেবল তার ধুমকেতুর মতো হঠাৎ আবির্ভাব ঘটে; কান্না,হাসির সাময়িক আবেগপরায়ণ মুহূর্ত সৃষ্টি করে আবার কিছুকালের জন্য তার তিরোভাব ঘটে। আমি যখন বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, রাস্তায় তখন এমনি একটা স্মৃতি আমাকে কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছিল। আজ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার একটু স্মৃতিচারণ করছি।
স্কুল জীবনে আমি ছাত্র হিসেবে বেশি ভালো ছিলাম না। একেবারে "লাস্ট ব্রেঞ্চের ছাত্র" যাকে বলে।তবে আমার একটা ভালো গুণ ছিল এটাকে অভ্যাসও বলতে পারেন। আমি নিয়মিত স্কুলে যেতাম। আমাকে গল্পের আদুভাইয়ের সাথে তুলনা করলেও ভুল হবে না তবে ওনার মতো একই ক্লাসে দীর্ঘদিন থাকার সৌভাগ্য আমার কখনোই হয় নি। আমি প্রতিক্লাসে পাশ করেছি ঠিকি তবে সবচে কম মার্ক নিয়ে।
যেমন:
বাংলায় আমি ৩৯ এর বেশি এবং ৩৩ এর কম কখনোই পেতাম না। প্রায় সব বিষয়েই এমন ব্যাপার ছিল। মূলত আমার নাম্বারের গণ্ডি ছিল ৪০ এর নিচে এবং ৩৩ এর সমান কিংবা একটু উপরে।
যেমন:
বাংলায় আমি ৩৯ এর বেশি এবং ৩৩ এর কম কখনোই পেতাম না। প্রায় সব বিষয়েই এমন ব্যাপার ছিল। মূলত আমার নাম্বারের গণ্ডি ছিল ৪০ এর নিচে এবং ৩৩ এর সমান কিংবা একটু উপরে।
একবার আমি ধর্মে ৪০ পেয়েছিলাম। সেজন্য ধর্ম স্যারকে জানাই স্যার আমাকে ১নাম্বার বেশি দিয়েছেন কেন?
(স্যার তো অবাক!)
-এসবের মানে কি?
-স্যার, খাতাটা আবার হিসেব করে দেখুন তো সব ঠিকঠাক আছে কি না?
(স্যার তো অবাক!)
-এসবের মানে কি?
-স্যার, খাতাটা আবার হিসেব করে দেখুন তো সব ঠিকঠাক আছে কি না?
পরে অবশ্য খাতা হিসেব করে জানা গেছে যে, স্যার ভুলে এক নাম্বার বেশি যোগ করে ফেলেছিলেন।
যাহোক, তখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছি কি দেই নি অতোটা খেয়াল করতে পারছি না। একদিন ক্লাসে ম্যাজিস্ট্রেট স্যার আসলেন। চোখে চশমা, গায়ে কোর্ট ও গলায় টাই পরা।হাস্যোজ্জ্ব ল মুখে উদ্দীপ্ত কণ্ঠে শরীরের লোমহর্ষক কিছু কথা বলেছিলেন।মূলত সেগুলো অনুপ্রেরণামূলক বাণী ছিল। সবশেষে তিনি ক্লাসের ফাস্ট বয় ও লাস্ট বয়কে সবার সামনে ডেকে নিয়েছিলেন। ফাস্ট বয় তো ভালোভাবে যাচ্ছিল কিন্তু আমি ভয়ে প্রায় কাঁপছিলাম। আমার অবস্থা দেখে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল কিন্তু স্যার সবাইকে ধমকের স্বর বলেছিলেন,
- তোমরা হাসছ কেন? ওকে দেখে হাসার কি আছে? তাছাড়া এখন ও তোমাদের চেয়ে একটু বেশি দামি কেন বলো তো? কারণ ও যদি দামিই না হতো তাহলে তোমাদের রেখে ওকে কেন এখানে ডেকেছি। তোমরা ওকে দেখে আজকে হাসছো? দেখবে এমন একদিন আসবে যেদিন ওর কথা ভেবে ভেবে তোমরা নিজেরাই কাঁদবে শুধু এই ভেবে ইশ! যদি ও মতো হতে পারতাম তবুও জীবনটা সার্থক হতো।
- তোমরা হাসছ কেন? ওকে দেখে হাসার কি আছে? তাছাড়া এখন ও তোমাদের চেয়ে একটু বেশি দামি কেন বলো তো? কারণ ও যদি দামিই না হতো তাহলে তোমাদের রেখে ওকে কেন এখানে ডেকেছি। তোমরা ওকে দেখে আজকে হাসছো? দেখবে এমন একদিন আসবে যেদিন ওর কথা ভেবে ভেবে তোমরা নিজেরাই কাঁদবে শুধু এই ভেবে ইশ! যদি ও মতো হতে পারতাম তবুও জীবনটা সার্থক হতো।
ম্যাজিস্ট্রেট স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল
-তুমি কি ওদের হাসার যোগ্য জবাব দিতে পারবে না?
তুমি কি পারবে না এই ক্লাসের ফাস্ট বয় হতে?
-তুমি কি ওদের হাসার যোগ্য জবাব দিতে পারবে না?
তুমি কি পারবে না এই ক্লাসের ফাস্ট বয় হতে?
কথাগুলো আমার ভেতরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
স্যার আবার বললেন,
-তুমি সবার সামনে বলো যে, "আমি পারব!"
-তুমি সবার সামনে বলো যে, "আমি পারব!"
আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুচ্ছিল না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর সবার অবজ্ঞার দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করছিলাম।
স্যার আবারও প্রশ্ন করলে আমি প্রতিবর্তী ক্রিয়ার মতো মনের অজান্তে উচু গলায় বলে ফেললাম 'আমি পারব।"
সেদিন থেকে আমার নতুন জীবন শুধু শুরু হয়েছিল। তারপর এস এস সিতে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে স্থানীয় কলেজে পড়েও এইচ এস সি তে এ+ পেয়েছিলাম।সেবার আমাদের কলেজ থেকে একজন ঢাবিতে চান্স পেয়েছিল। সেই একজনই ছিল লাস্ট বেঞ্চের সেই অবজ্ঞার ছাত্রটি।সেই ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের নাম আমি জানি না, তিনি বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না,শুধু তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত অমর বাণীগুলো আজো আমার কানে বাজে।যার জন্য আজ আমি সফল তাঁকে অন্তত ধন্যবাদও দিতে পারি নি অথচ আজ আশেপাশে কত মানুষ!
আমার ইউনিভারসিটি শেষ হয়েছে গত কয়েক বছর হলো।এখন একটা কোম্পানিতে জব করছি। সেখান থেকে ফিরতে রাত হয়েছে আর এজন্যই বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিলাম এতক্ষণ। এখন আমি বাড়ির সন্নিকটে এসে পড়েছি।
No comments